রিনির সাথে আমার পরিচয় একেবারেই হুট করে।
একটি শপিং মলের সেকেন্ড ফ্লোরে আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম উবার ডাকব না পাঠাও, তখনই সে আমাকে এসে বলল- আমি রিনি!
আমি ভ্রু কুঁচকে ভাবছিলাম, তো আমি কী করব!
হঠাৎ মনে হলো, মেয়েটা কি ঋণী বলল! বেশীরভাগ বাঙালী ঋণকে রিন উচ্চারণ করে! এও কি সেরকম!
মেয়েটার প্রতি খানিকটা মায়া জন্মালো! আহারে! এই অল্প বয়সে, তার নিশ্চয় অনেক ঋণ!
আমি কিছু একটা বলতে যাব, তখনই সে বলল- অমন হাঁ করে কী ভাবছ! মুখে মাছি ঢুকে যাবে!
এই ঝকঝকে পরিষ্কার জায়গায় মাছি আসবে কোত্থেকে সেটাই আমি ভেবে পেলাম না।
তাকে বলা আমার প্রথম কথা ছিল- এখানে মাছি নেই।
এবার সে একটু ভ্রু কুঁচকালো! কিন্তু অতটা না, খুবই অল্প। নিশ্চয় খুব রুপ সচেতন, কপালে ভাঁজ পড়ুক সেটা সে চায় না।
সে বুঝার চেষ্টা করছে আমি কি রসিকতা করেছি, না আসলেই এমন আঁতেল টাইপ আমি!
মেয়েরা ছেলেদের মত বেশীক্ষণ যেমন তাকায় না, বেশীক্ষণ ভাবেও না।
তাই অত ভাবাভাবির মধ্যে না গিয়ে সে বলল- চলো, কোথাও বসি!
ব্যাপারটাতে আমি খুব টেনশন পড়ে গেলাম। ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে এই মেয়ে আমার পরিচিত, আবার প্রথম দেখাতেই তুমি করে বলছে!
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমি তাকে মনে করতে পারছিনা কোনোভাবেই।
এমনটা তো হওয়ার নয়। প্রথমত আমি কাউকে কখনো ভুলিনা, দ্বিতীয়ত এই নামের কাউকেই আমি কখনো চিনিনা।
ভাবনা কাটতেই আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম, আমি এই মেয়ের সাথে হাঁটছি। সে আমার হাত ধরে অনেকটা কুরবানীর সুবোধ গরুর মত টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে সে বলছে, বাই দ্যা ওয়ে আমার নাম কিন্তু নীহা নয়, ওটা আমার ফেইক নেইম। আসল নাম রিনি, এজন্যই তুমি বুঝতে পারনি।
বলেই সে হাহা করে হাসছে। যেন তার খুব কাছের কাউকে বোকা বানিয়ে খুব মজা পেয়েছে।
তোমার নামও নিশ্চয় রকি নয়। আসল নাম কি তোমার?
এবার ঘটনা আমার কাছে মোটামুটি পরিষ্কার। রিনি নামের এই মেয়েটি রকি নামের একটি ছেলের সাথেই দেখা করতে এসেছে।
এখন ভাবছে রকি নামের ছেলেটাই আমি।
” আচ্ছা তুমি বলেছিলে ব্লু টিশার্ট পরবে, কিন্তু পরেছ ব্লু শার্ট, আর তুমি না বলেছ অনেকগুলো ব্লু ব্রেসলেট পরা থাকবে তুমি? সে সব কই? আচ্ছা যাই হোক, এখনো খুব ভাল লাগছে দেখতে।”
সে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে। তা থেকে যা বুঝলাম,
রিনি দেখা করতে এসেছিল টেক্সট ভিত্তিক একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পরিচিত একজনের সাথে, যার সাথে তার কখনো দেখা হয়নি, এমনকি ছবিও দেখেনি। ছেলেটিকে সে বলেছিল ব্লু টিশার্ট, ব্লু জীন্স পরে আসতে।
দূর্ভাগ্যক্রমে আমি ব্লু শার্ট আর ব্লু জীন্স তো পরেছিই, এক জোড়া ব্লু স্নীকার্সও পরেছি।
ঘটনা মোটামুটি আমি বুঝতে পারছি।
কিন্তু ঘটনা হচ্ছে সে বুঝতে পারছেনা আমি আসলে রকি না। এমনকি ইংরেজীর সমস্ত অ্যালফাবেট মিলিয়েও এই নামের সাথে আমার নামের একটি অক্ষরও কমন নেই।
ভাবনা কাটলো তার ডাকে। কী ভাবছ? বললাম না আমার নাম রিনি?
কেউ নিজের নাম বললে, আমার নামটাও বলাটা ভদ্রতা। আমি যেহেতু ছেলে হিসেবে মাশাল্লা অতি চমৎকার ভদ্র, তাই নিজের নাম বললাম।
আমার নাম ফাতিহ।
-এটা তোমার রিয়েল নেইম?
হ্যাঁ।
-ফাতিহ কারো নাম হয়?
আমার নাম ফাতিহ।
-এটা কেমন নাম?
এটা ঐতিহাসিক নাম।
সে আবার হা হা করে হাসছে। হাসলে নাকি স্বাস্থ্য ভাল থাকে। এই মেয়ে নিশ্চয় খুব স্বাস্থ্য সচেতন।
রিনি হঠাৎ বলল, চলো কিছু খাই!
– না না, আমার খিদে নেই।
:বিল আমি দেব, চলো!
যেসব মেয়েরা নিজ থেকে বিল দেয়, তারা মেয়ে হিসেবে হয় অসাধারণ।
এমন অসাধারণ এক মেয়েকে ফিরিয়ে দেয়া হবে অন্যায়। আপাতত অন্যায় করতে ইচ্ছে করছেনা।
সে অনেকটা জোর করেই একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকালো।
তাকে বললাম, দেখ! তুমি যাকে ভাবছ, আমি কিন্তু সে নই।
-জানি জানি, তুমি রকি নও, তুমি ফাতিহ।
বলার ভঙ্গীর মধ্যেই সবজান্তা মত একটা ভাব আছে। সে ভাবছে আমি মজা করছি।
কী কঠিন নাম! তাও আবার নাকি ঐতিহাসিক!
-হ্যাঁ।
:কেন এমন একটা নাম রাখলো বল তো তোমার?
নিজের নামের জন্যও যে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে, কবে কে ভেবেছিল সেটা!
– কন্সটানটিনোপোল বিজয়ী ওসমানী সুলতান মুহম্মদ ফাতিহ খানের নামে এই নাম রাখা হয়েছে!
:কন্সটানটিনোপোল? এটা অনেক পুরনো শহর না?
(বাহ! মেয়ে দেখছি অনেক কিছুই জানে! সাধারণত সুন্দরীদের এসব জ্ঞান থাকে কম। কারণ তারা জ্ঞানচর্চার চেয়ে সৌন্দর্য চর্চাকেই বানিয়ে নিয়েছে ধ্যানজ্ঞান।)
-অনেক পুরনো, বাইজেন্টাইনদের কাছ থেকে সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ এটা জয় করেন।
কোথায় এই শহর?
(কৈফিয়ত চাচ্ছে না জানতে চাচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছিনা। মনে হচ্ছে জানার আগ্রহ আছে। নাকি সেই শহরের এক্স্যাক্ট লোকেশন জানতে চায়?)
-বর্তমান ইস্তাম্বুলের পূর্বনাম হচ্ছে কন্সট্যানটিনোপোল।
:জানতামই না!
মেয়ের সহজ সরল স্বীকারোক্তি পছন্দ হয়েছে। আজকাল কেউ না জানলে সেটা স্বীকার করেনা।
হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো, তুরস্ক তো অটোমানরা শাসন করতো, তাদের থেকে সুলতান হতো।
-হ্যাঁ। তুমি কীভাবে জানো?
:সুলতান সুলেমান, দিরিলিস আরতুগ্রুল দেখি তো! আর এক আধটু পড়েছিও। এবার বল যে, অটোমানরা তুরস্ক শাসন করতো, তাহলে ওসমানীরা কখন ছিল?
(ইতিহাস শুনে বিরক্ত হচ্ছেনা। রেয়ার সুন্দরী। ভাবছি উত্তর দিই।)
-ওসমানী খেলাফতকে ইংরেজরা অটোমান এম্পায়ার বলতো!
সে অনেকটা ভীমড়ি খেল!
:ওসমানীরা আর অটোমানরা এক?
-অবশ্যই এক। আরতুগ্ রুল এর ছেলে ওসমান এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামেই ওসমানী সাম্রাজ্য।
:আল্লাহ্! ওসমানীদের কথা কোথায় যেন পড়েছিলাম! কিন্তু ওসমানীরাই যে অটোমান সেটা তো জানতামই না।
-অনেকেই জানেনা।
(অনেকের সাথে মেলানোতে রাগ করলো কিনা বুঝা গেল না। সাধারণত পৃথিবীর সাড়ে তিনশো কোটি মেয়েই আলাদা, কেউ ‘অন্য মেয়েদের মত’ না।)
:আচ্ছা সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ খান সুলতান সুলেমান খানের কী ছিলেন? তাকে কখনো দেখিনাই সিরিয়ালে।
-সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ ছিলেন সুলতান সুলেমানের পর দাদা। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সে কনস্ট্যানটিনোপোল দখল করেন।
বাইজেন্টাইনরা মনে করতো কন্সট্যানটিনোপোল কেউ কখনো দখল করতে পারবেনা, এটি একটি অজেয় শহর।
হযরত মুহাম্মদ (স) কন্সট্যানটিনোপোল বিজয়ের ভবিষ্যৎ বানী করেছিলেন, এবং বিজয়ীর জন্য দোয়া করেছিলেন।
:তুমি একটা জ্ঞানের বাকশো!
-আরেহ না! আমি হচ্ছি জ্ঞানের ব্যাগ, সবাইকে বিলি করে বেড়াই।
সে আবার হা হা করে হাসছে। একেবারে নিখুঁত দাঁত, মাঝখানে শুধু একটা দাঁত বাঁকানো। দেখে মনে হচ্ছে ডিজাইনটাই এমন, ইচ্ছে করে একটা বাঁকানো হয়েছে।
এভাবে আলোচনা চলছে। যেন আর থামছেই না।
খাবার খেতে খেতে আমি প্রসঙ্গ ঘুরালাম!
বললাম, তোমাকে সুন্দর লাগছে। কাউকে সুন্দর লাগলে সেটা জানানো দরকার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সুন্দরীরা অযথাই এই প্রশংসা শুনে অভ্যস্ত।
সে অন্য একজন ভেবে আমার সাথে কথা বলছে! কী একটা গিফটও নিয়ে এসেছে আমার জন্য।
অন্যের জন্য আনা গিফট আমি কীভাবে নেব!
তাকে আবার বললাম, আমি কিন্তু সে না!
সে বিশ্বাসই করছেনা। ভাবছে আমি ইয়ার্কী করছি।
অবশেষে চিন্তা ছেড়ে দিলাম। নাহ! মেয়েরা কোনো ব্যাপার বিশ্বাস করতে না চাইলে সেটা বিশ্বাস করানো এত সহজ বিষয় না। এরচেয়ে সমুদ্রে ডুব দিয়ে খালি হাতে মাছ ধরে আনা সহজ।
তার দিকে তাকাতে তাকাতে ভাবছি, বুঝানোর চিন্তা ছেড়ে দেব, নাকি তার চিন্তা ছেড়ে দেব!
অবশেষে বুঝানোর চিন্তাটাকেই ছেড়ে দিলাম।
যে বুঝতে চাচ্ছেনা, তাকে কীই বা বুঝাবো!
“আচ্ছা তোমার ভয়েস কিন্তু ফোনে অন্যরকম!”
আমি চমকে উঠলাম! যার সাথে দেখা করার কথা সে ফোনেও কথা বলেছে! সর্বনাশ!
এতক্ষণ বুঝাতে চাচ্ছিলাম, রকি আমি না, তখন বুঝতেই চায়নি। এখন যখন চিন্তা করলাম, একে ছাড়বো না, আমি রকি হয়ে যাই! তখনই কিনা ধরা খেয়ে যাচ্ছি।
হে ধরণী, তুমি এত জটিল কেন!
আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম- কয়বার কথা বলেছি আমরা ফোনে?
-একবারমাত্র।
আহ্! বাঁচলাম।
এবার ছাড়লাম প্রথম মিথ্যেটা;
ওটা আমি ছিলাম না।
-কে ছিল তাহলে?
আমার ফ্রেন্ড।
-তোমার ফ্রেন্ডকে দিয়ে কথা বলিয়েছ তুমি আমার সাথে?
আমি তো ফোনে কথা বলতে পারিনা, কী করব!
-তাই বলে ফ্রেন্ডকে দিয়ে কথা বলাবে!
আমার আসলে ফোন ছিল না, তার ফোন থেকেই তোমার সাথে চ্যাট করতাম, আইডিও তার!
সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
-তুমি ফ্রেন্ডের আইডি থেকে চ্যাট করেছ! তাকে দিয়ে কথা বলিয়েছ আমার সাথে??
সে অনেকটা রেগে যাচ্ছে।
-আমার ফোন ছিল না, কী করব!
:পরে কেন বলনি?
আজকে বলব ভেবে!
সে অনেকটা শান্ত হলো!
তুমি ঐ সিমটা অফ করে দিতে পারবে? আমার ফ্রেন্ড কিন্তু ডিস্টার্ব করতে পারে!
-এমন ফ্রেন্ড কেন তোমার?
:কী করব! ছোট বেলার ফ্রেন্ড তো, ফেলে দিতে পারিনা। সিম হলে ফেলে দিতাম।
-ঐ সিমটা এমনিতেও ইউজ করিনা, তোমাকে ফোন দেয়ার জন্য খুলেছিলাম, সারাবছর অফই থাকে।
(বাহ! তাহলে তো বেশ! মনে হচ্ছে বুকের ছাতি ফুলে উঠছে আমার)।
আর আইডিটা তোমার জন্যই রেখে দিয়েছিলাম। আজকে ডিলিট করে দেব, ভাল লাগেনা।
-আচ্ছা, আমার এখনের নাম্বার নাও।
নাম্বার বিনিময় হলো।
আমি অনেকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, ঐ ছেলের সাথে আর দেখা হবেনা।
মেয়েরা কী অদ্ভুত! এতক্ষণ ধরে সত্যি বলছিলাম, একটাও বিশ্বাস করেনি।
সব মিলিয়ে দুটো মিথ্যা বলেছি, সাথে সাথে বিশ্বাস করে নিয়েছে।
এজন্যই মহা মনিষীগণ বলেছেন, মেয়েদের বুঝা বড় দায়।
সে সত্যি সত্যি আমাকে বিল পে করতে দেয়নি।
সে বিল পে করলো, তারপর আমরা বেরিয়ে এলাম।
কথা বলতে বলতে আমরা এগুচ্ছিলাম, হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম একটা ছেলে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এস্কেলেটর বেয়ে উপরে উঠছে, রিনির সাথে পরিচয়ের সময় আমি যে জায়গায় ছিলাম সেদিকে এগুচ্ছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।
গায়ে ব্লু টিশার্ট, ব্লু জীন্স, হাতে ব্লু ব্রেসলেট, বুকে লকেট ঝুলানো, তাতে লেখা Rocky।
আমার ভেতরের পৈশাচিক শক্তি তখন জেগে উঠলো, বলল একশনে যা পাগলা!
রিনি তাকে দেখেছে কিনা দেখলাম!
না, রিনি সেটা খেয়াল করেনি।
তাড়াতাড়ি বললাম, চলো আমরা লিফট দিয়ে নামি!
সে অবাক হলো!
-কেন? মাত্র সেকেন্ড ফ্লোরই তো!
দেরী হচ্ছে, চলো! শুরুতে সে আমাকে যেভাবে টেনেছিল, এখন আমি তাকে সেভাবে টানছি।
অনেকটা জোর করে তাকে নিয়ে আমি লিফটে ঢুকে গেলাম।
নামতে নামতে সে বলল, দেখেছ! ফোন না করেও দেখা হয়! তুমি বিশ্বাসই করতে চাচ্ছিলেনা। “নাম্বার দাও, দাও!” দেখলে তো দেখা হলো?
বলেছিলাম ক্যাটস আইয়ের সামনে দাঁড়াবে, তুমি দাঁড়িয়েছ, আমিও খুঁজে পেয়েছি।
দেখা হওয়ার থাকলে ফোন লাগেনা।
আমিও মুচকি হেসে সায় দিলাম।
লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এসেছে, বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। তাকে একটা রিকশায় তুলে দিলাম। সে উঠে বসেই জিজ্ঞেস করলো-
আচ্ছা, ফাতিহ মানে কী?
ততক্ষণে রিকশা চলতে শুরু করেছে।
আমি অনেকটা চিৎকার করে বললাম- বিজয়ী।
সে হুডের পাশ দিয়ে মুখ বের করে বলল- বাসায় গিয়ে ফোন দেব।
আমি আরো একবার বিজয়ের হাসি দিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম।
Source: Facebook.