ভূমিকা : পৃথিবী ডিজিটাল হচ্ছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশে লেগেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোয়া। সকল ক্ষেত্রেই সেই সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তন করে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যাবহৃত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০২২ সালের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রুপান্তর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এবং এই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে সরকার অনবরত কাজ করে যাচ্ছে। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে একটি পদক্ষেপ হলো মহাকাশে বাংলাদেশের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ। যার নামকরণ করা হয়েছে আমাদের জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ নামে।যেটি দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলে মহাকাশে বাংলাদেশ নামক ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নাম লিখেছে।যা বাংলাদেশর একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমাদের অনেক বড় পাওয়া।এবং এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৫৭ তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ কারী রাষ্ট্র হিসেবে নাম লিখিয়াছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের যাত্রা: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের যাত্রা শুরু হয় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ সংস্থা BTRC এর কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ বিষয়ক একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে। এর থেকে যাত্রা শুরু হয় স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেওয়ার জন্য। এর পড়ে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জাতীয় তথ্য প্রযুক্তি নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণ বিষয়টি সংযুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেঢশন ইউনিট এর সাথে যোগাযোগ করা হয় বাংলাদেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য। এবং বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট এর নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল কে নিয়োগ দেয়া হয়। এবং বঙ্গবন্ধু ১ স্যাটেলাইট কিনতে ফ্রান্সের স্যাটেলাইট নির্মাতা কোম্পানি থ্যালেস আলোনিয়া স্পেসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ। এবং তাদের সঙ্গে ৯৫১ কোটি ৭৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশের ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয় বিটিআরসি। এবং অরবিটাল স্লট বা কক্ষপথ কেনার জন্য রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারেস্ট বুটলিকের সঙ্গে চুক্তি করা হয় ২০১৫ সালে। এবং ২০১৭ সালে স্যাটেলাইটের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড নামক একটি সংস্থা গঠন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর নির্মাণ ব্যয়: ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একনেকের সভায় ৯৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ এর মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনার জন্য। ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয় বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল হতে এবং বাকি ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সংগ্রহের জন্য বিডার্স ফাইনান্সিং এর সহায়তা নেয়া হয়। এবং ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এইচএসবিসি এর সাথে সরকার ১ দশমিক ৫১ শতাংশ সুদের ১৪০০ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে যা ১২ বছরে মোট ২০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।
Read more>>>: পদ্মা সেতু রচনা
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ হলো বাংলাদেশের সর্ব প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ যা ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৮০০ কিলোমিটার উপরে অবস্থিত হয়েছে। এটি geostationary Earth orbit এর একটি উপগ্রহ । এটি মূলত একটি ভূ স্থির উপগ্রহ। এটি জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট যা নিরক্ষরেখা বরাবর ২৪ ঘন্টায় একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে থাকে। এবং এটি পৃথিবীর আবর্তনের বিপরীত দিক থেকে প্রদক্ষিণ করবে অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে এটি আবর্তন করে থাকে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটটি থাকবে নির্দিষ্ট একই জায়গায় স্থির। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মেয়াদ ১৫ বছর। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে পাঠানো তথ্য গ্রহণ করবে এবং তার কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে আবার তা ফেরত পাঠাবে পৃথিবীতে। এবং বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ওজন ৩৬০০ কেজি যা বাংলাদেশের নিজস্ব অরবিটাল স্লট ৬৯ ডিগ্রি ও ১০৩ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশে পাওয়ার কথা। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন ২০০৭ সালে বাংলাদেশ মহাকাশের ১০২ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করে ITU এর কাছে। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে এই অর্বিটল স্লট বরাদ্দ দেওয়ায় আপত্তি জানায়।
পরবর্তী সময়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে ৬৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ বরাদ্দ দেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। তারা জানায় এর ফলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া সিগনাল এর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। পরবর্তীতে বাধা হয়ে দাড়ায় সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া।এবং বাংলাদেশের ৬৯ থেকে অর্বিটাল স্লট বরাদ্দ বাতিল হয়ে যায়।পরবর্তীতে ১১৯.১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ অরবিটাল স্লট বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান intersputunik international organisation of space communication . বাংলাদেশের ডাক ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি ইন্টারনেটের সাথে ১৫ বছরের চুক্তি করে এবং তা তিন কিস্তিতে ৪৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যাবে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ১৫ জানুয়ারি ২০১৫ সালে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট রয়েছে মোট ৪০ টি ট্রান্সপন্ডার। যা ১৬০০ মেগাহার্টজ ক্ষমতা সম্পন্ন। এগুলোর মধ্যে ২৬ টি ku-band এবং ১৪টি সি ব্যান্ড এর।KU Band বাংলাদেশ সহ বঙ্গোপসাগর,পাকিস্তান,ভারত নেপাল, ভূটান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন,মিয়ানমার সহ আরো অনেক দেশ পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে এছাড়াও C Band আরও ২৬ টি দেশের উপর বিস্তৃত রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সুবিধা সমূহ: বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আমাদের দেশের তথ্য প্রযুক্তিতে নতুন দিক উন্মোচন করেছে। এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমাদের দেশটি আরো ডিজিটাল দেশে রূপান্তরিত হবে। এখন আর তথ্য প্রযুক্তির জন্য আমাদের ভিন্ন দেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না। কারণ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আমরা নিজেরাই এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। এছাড়াও আমাদের দেশে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে স্যাটেলাইট টিভি ।যেগুলোকে বিদেশি স্যাটেলাইট কোম্পানি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করার মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করতে হতো। এবং এই টাকা খরচ করা হতো টিভি চ্যানেলগুলোর ফ্রিকুয়েন্সি কেনার জন্য। কিন্তু বর্তমানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তৈরি হওয়ায় এ সকল টেলিভিশন চ্যানেল গুলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে স্থানান্তর করা হয়েছে। এরপূর্বে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হতো বিদেশি কোম্পানি গুলোকে। যার ফলে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক দিকেও প্রভাব পড়ত। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের টাকা অন্য দেশে যাওয়ার পরিবর্তে অন্য দেশকে সেবা প্রদানের মাধ্যমে আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।
এছাড়াও এই স্যাটেলাইট বিদেশী কোম্পানীর নিকট সেবা প্রদানের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব ।যার মাধ্যমে স্যাটেলাইট তৈরি সমস্ত খরচ উঠিয়েও লাভবান হওয়া সম্ভব। তবে এর জন্য আমাদের অবশ্যই ধৈর্য্য ধরা উচিত কেননা প্রথম থেকে কোন কিছু করে লাভবান হওয়া যায় না। তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে আয়ের এর আরো নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হচ্ছে ।এবং ভবিষ্যতে এগুলো আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশের এই সেবার মানোন্নয়ন করা সম্ভব । স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিমিডিসিন , ভিডিও কনফারেন্সিং ,প্রতিরক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সকল সুবিধা পাওয়া যাবে। এছাড়াও এর মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল রয়েছে যেগুলোতে এখন পর্যন্ত আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি । এবং ইন্টারনেট সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছায়নি । সেখানে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মোবাইল নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।এছাড়াও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন আবহাওয়া বার্তা সংগ্রহ করা যাবে। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস গুলো এখন নিজেরাই সংগ্রহ করতে পারবে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
সর্বোপরি বলা যায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলাদেশের জন্য একটি আশীর্বাদ স্বরূপ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে একটি অন্যতম কার্যকরী পদক্ষেপ হচ্ছে দেশের জন্য স্যাটেলাইট তৈরি। এর ফলে আমাদের দেশের উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত হয়েছে এবং পৃথিবীর অন্যতম উন্নয়নশীল দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশ একই ধারায় উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন আমাদের দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির পথ সুগম হচ্ছে তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হচ্ছে। কারণ ইতিপূর্বে বাংলাদেশের আগে পৃথিবীর মোট ৫৬ টি দেশ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণে সফল হয়েছে। ৫৭ তম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনকারী দেশ হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ।
উপসংহার: যেখানে সফলতা রয়েছে সেখানে ব্যর্থতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এই ব্যর্থতাকে জয় করাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য। তাহলেই সফল হওয়া যাবে। তাই পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ এবং বাংলাকে অনন্য এবং গর্বিত করেছে এই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা।