টিং টং করে হঠাৎ আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি ঈশিতার ফোন। হ্যালো ঈশিতা ভালো আছিস? হ্যাঁ ভালো আছি রিনি। তারপর ঈশিতা বলল কাল ভার্সিটিতে কয়টায় আসবি? আমি বললাম কাল কেন? আরে তুই ভুলে গেছিস, কালনা আমাদের নবীন বরণ। ও আচ্ছা আচ্ছা তাই তো। আমি কাল সকাল বেলায় ভার্সিটিতে আসবো। ঠিক আছে ঈশিতা তাহলে এখন ফোন রাখি। ok রিনি। ঈশিতা হলো আমার কলেজ বান্ধবী। সে অনেক সুন্দর, অনেক লম্বা, তবে বেশ চঞ্চল। ইশিতা পড়াশোনা একটু অমনোযোগী। তবে পরীক্ষায় ভালো পাস করে। পরদিন সকালে আমি ভার্সিটিতে গেলাম। দেখি ঈশিতা নীল শাড়ি পড়ে এসেছে। নীল শাড়িতে তাকে যেন নীল পরীর মত লাগছে।
আমি, ঈশিতা ও আমরা নতুন যারা ভর্তি হয়েছি সবাই একসাথে বসলাম। একটু পরেই সিনিয়র আপু ও ভাইয়ারা আমাদেরকে ফুল, চকলেটও কলম দিয়ে বরণ করল। সন্ধ্যা হয়ে গেল আমি ও ঈশিতা ভার্সিটি থেকে বের হয়ে বাসায় চলে আসলাম। দুদিন পর ভার্সিটিতে আসলাম, ক্লাসে ডুকেই আমি 2nd বেঞ্চে বসলাম । পেছন থেকে কে যেন আমাকে রিনি বলে ডাক দিল।মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম ঈশিতা আমার পেছনের বেঞ্চে বসলো। আমার কাধের উপর হাত দিয়ে সে বললো কি খবর দোস্ত? আমি বললাম ভালো ঈশিতা,তুই?হ্যা, আমিও অনেক ভালো আছি।
কিছুক্ষণ পর কয়েকজন সিনিয়র ভাইয়া আমাদের ক্লাস রুমে আসলো তারা আমাদের কে বলল যদি তোমাদের কোন সমস্যা হয় তাহলে আমাদেরকে জানাবে যদি কোন বই কিংবা বুকলিস্ট লাগে তাও আমরা তোমাদেরকে দিব। আমার পিছনে ঈশিতা আস্তে আস্তে বলতে লাগল যে অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম চুপ কর ঈশিতা। ক্লাস শেষ করে বের হওয়ার সময় একটা সুন্দর লম্বা হ্যান্ডসাম সিনিয়র ভাইয়া একটা কাগজ ঈশিতার হাতে ধরিয়ে দিল। এটা দেখে আমি তো অবাক হয়ে গেলাম! ঈশিতা তড়িঘড়ি করে কাগজটা খুলে দেখল, দেখে বলল এইটা কি? বুক লিস্ট!আরে আমি ভাবলাম কি না কি? আমরা দুজনেই ভাইয়াটাকে থ্যাঙ্কস জানালাম। ভাইয়াটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন সিনিয়র ভাইয়া আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলতে লাগল এই বইগুলো পড়েই কিন্তু রিপন ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে।
এতক্ষণে বুঝলাম এই ভাইয়ের নাম রিপন। তারপর রিপন ভাইকে আমরা বললাম ভাই আজকে তাহলে আসি। রিপন ভাই ও বলল ঠিক আছে আসো। রিকশায় বসে আমি বললাম ঈশিতা সিনিয়র ভাইয়েরা অনেক হেল্পফুল তাইনা? ঈশিতা হাতে মোবাইল টিপতে টিপতে অন্যমনষ্ক হয়ে বলল হুম। আমি ঈশিতার হাত ধরে বললাম তুই ব্যস্ত নাকি? ঈশিতা চমকে উঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল আর বলিস না আমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে অনেক ঝামেলায় আছি। ভাবতেছি ওকে ক্লোজ করে দিবো। মানে! মানে ব্রেকআপ করে দিব।
কখন যে রিলেশন করেলি সেটা জানতে পারলাম না আর এখন ব্রেকআপ করে দিবি সেটা জানতে পারলাম। সে আমাকে উত্তর দিল কত আশে কত যায় তোকে কোনটার কথা বলবো বল ? আমি ঈশিতা কে বললাম রিয়েল ভালোবাসা একটাই হয় অনেক গুলো না। ঈশিতা আমার কথা শুনে হাসতে লাগল। আমি আমার বাসার সামনে রিকশা থেকে নেমে গেলাম ঈশিতা ওর বাসায় চলে গেল। দুদিন পর আমি ভার্সিটিতে গেলাম । ক্লাস রুমে ঢুকতেই দেখি ঈশিতা পিছনের বেঞ্চে বসে ফোনে কথা বলছে।
আমি যথারীতি সেকেন্ড বেঞ্চে বসলাম। আমি কিন্তু সেকেন্ড বেঞ্চে বসতে খুব পছন্দ করি, তাই সবসময় অন্য বেঞ্চে খালি থাকলেও আমি সেকেন্ডই বেঞ্চে বসি। আমার সামনে এবং পাশের ফ্রেন্ডরা নিজেরা নিজেরা গল্প করছিল ওরা সবাই একই কলেজ থেকে এসেছে। আমার কলেজ থেকে এ ভার্সিটিতে শুধু আমি ও ঈশিতা চান্স পেয়েছি আর আমার বাকি বন্ধুরা অন্য ভার্সিটি গুলোতে চান্স পেয়েছে।। ক্লাস শেষ করেই বের হওয়ার সময় ঈশিতা আমার হাতটা ধরে বলল চল ক্যান্টিনে যাব তোকে সারপ্রাইজ দিবো। ক্যান্টিনে বসার পর ঈশিতা অনেকগুলো খাবারের অর্ডার করলো এবং ফোন হাতে নিয়ে কাকে যেন ফোন দিয়ে বলল তুমি তাড়াতাড়ি ক্যান্টিনে আসো প্লিজ এক্ষুনি।
আমি ঈশিতা কে জিজ্ঞেস করলাম কাকে আসতে বললি? ঈশিতা বলল রিপন ছাগল। আমি বললাম রিপন কে? ও বললো চিনলিনা, আরে আমাদের সিনিয়র সে রিপন। দ্বারা ওয়েট কর, দেখবি, সে এখন আমার নতুন বয়ফ্রেন্ড বুঝলি। বলতে না বলতেই রিপন ভাই হাজির। আমি ওনাকে সালাম দিলাম। উনি বই এবং সাজেশন ভর্তি একটা ব্যাগ ঈশিতার হাতে দিলো এবং বলল এই বইগুলো পড়বা তাহলে অনেক ভাল রেজাল্ট করতে পারবা। আমি অবাক হয়ে গেলাম ওদের রিলেশন দেখে! মাত্র 2 দিনে, কি করে সম্ভব? খাওয়া-দাওয়া শেষে ক্যান্টিন থেকে বের হওয়ার সময় ইশিতার রিপন ভাইকে বলল চলো আজকে আমরা পার্কে যাব, রিপন ভাই বলল আজকে যেতে হবে? হ্যাঁ আজকেই যেতে হবে।
আমি ঈশিতাকে বললাম আমি যেতে পারব না আমার টিউশনি আছে। এই বলে আমি রিক্সায় করে বাসায় চলে আসলাম। রাত্রে ঈশিতাকে ফোন দিলাম ওদের লাভ স্টোরি শোনার জন্য বাট দেখি ওর ফোন ওয়েটিং। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিই তাও দেখি ওয়েটিং। এর ঘণ্টাখানেক পরে সে আমাকে ফোন দিল এবং আমি জিজ্ঞেস করলাম এতক্ষন কার সাথে কথা বলতেছো? সে বলব রিপনের সাথে। আমি আর ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না কারণ ও খুব সহজেই রিলেশন করতে পারে।
পরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে দেখলাম রিপন ভাই ও ঈশিতা এক সাথে হাত ধরে ক্যাম্পাসে হাঁটছিলো, দূর থেকে তাদেরকে খুব সুন্দর লাগতেছে দুজনে লম্বা তে সমান সমান। এভাবে তাদের প্রেম ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ার এবং ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত চলতে লাগলো। তাদের এই ভালোবাস দেখে মাঝে মাঝে হিংসা হতো কিন্তু তারপরও মন থেকে দোয়া করতাম তাদের এই ভালোবাসা যেন দীর্ঘজীবী হয়, সারাজীবন টিকে থাকে।
এরই মধ্যে রিপন ভাই বিবিএ কমপ্লিট করে এমবিএ-তে ভর্তি হলেন একই ভার্সিটিতে। অনেকদিন পর ভার্সিটিতে আসলাম ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট নেওয়ার জন্য।ঈশিতাও অসলো।দেখলাম ওর হাতে অনেকগুলো কার্ড। একটা কার্ড আমার হাতে দিয়ে বলল ধর, আমি কার্ডটা খুলে দেখলাম ঈশিতার বিয়ের কার্ড। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম রিপন ভাইয়ের সাথে? ও আমাকে রেগে বললো রিপন কেন হবে আমি যাকে বিয়ে করতেছি সে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব করে মাসে 40 হাজার টাকা স্যালারি পাই। আমি ওকে বললাম রিপন ভাইয়ের সাথে এতদিনের রিলেশনের কি হবে?
ঈশিতা আমার সাথে রেগেমেগে বলল দেখ রিনি আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। রিপন এখনও বেকার, কবে এমবিএ কমপ্লিট করবে, কবে একটা ভালো জব পাবে, কবে স্তব্লিস্ট হবে? ভালো জব নাও তো পাইতে পারে। কে এতদিন অপেক্ষা করবে বল বাদ দে তো সব, আমার বিয়েতে আসিস, এই বললেই ঈশিতা ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম সারারাত একটুও ঘুমাতে পারেনি। আমার চোখের উপরে ওদের দুজনের ঘুরে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া সব কিছুই ভাসতে লাগল।
আহা কত সুন্দর জুটি ছিল ওদের। কেন যে মেয়েটা এমন করলো?সতি্ ঈশিতাকে আমি নতুন করে চিনলাম! হায় রিপন ভাইয়ের এখন কি অবস্থা আল্লাহই জানে, উনি ঈশিতাকে অনেক ভালোবাসতেন। আমি ঈশিতার বিয়েতে যাইনি, কারণ আমার খুব খারাপ লেগেছিল ওর ব্যবহারে। আমার অন্য ফ্রেন্ডরা ওর বিয়েতে গিয়েছিল ওদের কাছে শুনলাম ঈশিতার বর নাকি ওর থেকে এক ইঞ্চি খাটো। আমি বিন্দুমাত্র অবাক হলাম না কারন এখন ঈশিতার কাছে টাকাটাই হচ্ছে বড়, মানুষটা না। যাইহোক খুব ভালো থাকুক সুখে থাকুক এটাই ওর জন্য দোয়া করি।
এরপর আর কখনও রিপন ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয়নি। দু’বছর পর আমি যখন বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কোচিং করতে ছিলাম হঠাৎ ম্যানেজার এসে বিজ্ঞপ্তি দিলেন আমাদের কোচিং থেকে এবারের বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রথম হয়ে কাস্টমস অফিসার হয়েছেন। কাল তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে সবাই উপস্থিত থেকো। পিছন থেকে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে ম্যানেজার স্যার কে জিজ্ঞেস করলেন স্যার ওনার সেলারি কেমন হতে পারে ম্যানলেজার স্যার বললেন উনার স্যালারিকমপক্ষে 70 থেকে 80 হাজার টাকা হবে, একটা গাড়ি পাবে প্লাস সরকারি কোয়ার্টার পাবে। সবাই বলল বাহ এটাতো রাজার হাল।
পরদিন কোচিঙের অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হলাম সামনে জায়গা পায়নি বলে পেছনে বসলাম। অনুষ্ঠান শেষে চিপগেস্ট অর্থাৎ কাস্টম অফিসার যখন বক্তৃতা দেওয়া আরম্ভ করল দূর থেকে উনাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগলো কিন্তু বুঝতেছিনা। যখন অনুষ্ঠান শেষ করে উনি বাইরে বেরিয়ে আসলেন অনেকে ওনার পেছন পেছন এলেন। উনি কিভাবে সাকসেসফুল হলেন, কোন বইগুলো ফলো করলো জিজ্ঞেস করলেন? আবার অনেকেই উনার ফোন নাম্বারটাও নিলেন। আমি সামনের দিকে যেতেই হঠাৎ থমকে গেলাম!কারণ এ আর কেওই না, আমার চির চেনা সেই রিপন ভাই।