পৃথিবীতে বহু মহামারী এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়েছে মানব সভ্যতা। যার কারণে মানবসভ্যতা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে বার বার। এ ধরনের বহু মহামাংরী বিভিন্ন সময়ে আঘাত হেনেছে। এবং এর কারণে বিলীন হয়ে গেছে অনেক সভ্যতা । আমরা ইতিহাসের পাতা খুলে দেখতে পাই বিভিন্ন সভ্যতার কথা। এগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকেও আমরা সে সম্পর্কে জানতে পারি। এ থেকে ধারণা করতে পারি কেন বিলীন হয়ে গিয়েছিল সেই সভ্যতা। এরকম একটি মহামারীর নাম হচ্ছে নভেল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ।যা বর্তমান বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ছোট বড় দেশ এবং প্রতিটি মানুষের ভিতরে শঙ্কার সৃষ্টি করেছে এই করোনা ভাইরাস। এই করোনা ভাইরাস এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে যার কারণে এটি নিয়ন্ত্রণ করা এক কথায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র বাঁচার উপায় হচ্ছে এই করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করা। এবং এর পাশাপাশি ব্যাপক গণসচেতনতা তৈরি করা। তবে তা এ পর্যন্ত সম্ভব হয় নাই। তবে গবেষকেরা দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে এর প্রতিশোধক আবিস্কার করার জন্য।
ভাইরাস কি:
এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈব কণা বা অণুজীব যারা জীবিত কোষের ভিতরেই মাত্র বংশবৃদ্ধি করতে পারে তাকে ভাইরাস বলে। এরা অতি-আণুবীক্ষণিক এবং অকোষীয় হয়ে থাকে। পৃথিবীতে বহু ভাইরাসের সৃষ্টি হয়েছে এই পর্যন্ত। এবং এদের মধ্যে অধিকাংশ ভাইরাসের ঔষধ আবিষ্কার হয়েছে এবং অনেক ভাইরাস রয়েছে যেগুলো মানুষের ভিতরে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি কম। এর মধ্যে কিছু কিছু ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করে। আবার কিছু কিছু ভাইরাস প্রতিরোধ করার ক্ষমতা মানুষের ভিতরে রয়েছে । অথবা এর ভয়াবহতা এমনভাবে প্রকাশ পায় না।
এছাড়াও এসকল প্রতিটি ভাইরাসের সংক্রমণের পদ্ধতি ও এক এক রকম। তাই এসকল ভাইরাস মারাত্মক হলেও এগুলো সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকার কারণে তেমন মহামারী আকার ধারণ করে না। আবার কিছু কিছু ভাইরাস দেখা যায় এমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে তার নিয়ন্ত্রণ করা মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই ভাইরাসগুলো বিভিন্ন প্রাণীর শরীর থেকে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং মানুষকে সংক্রমিত করে।
করোনা ভাইরাস কি:
করোনাভাইরাস হলো নিদুভাইরাস শ্রেণীর করোনাভাইরদা শ্রেণীভূক্ত করোনাভাইরিনা উপ গোত্রের একটি ভাইরাস। এবং এটি একটি সংক্রামক প্রজাতির ভাইরাস। এটি আরএনএ (RNA) ভাইরাস এর ভিতরে সবচাইতে বড় ভাইরাস (Virus)। এবং এটি 26 থেকে 30 কিলো বেস পেয়ার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এবং এই ভাইরাসটি নিজস্ব জিনোম এবং আরএনএ দিয়ে গঠিত। এবং এটি দ্রুত এর প্রকৃতি পরিবর্তন করে। যার ফলে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার আরও দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পর্যন্ত মোট সাত প্রকার করোনা ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে। এবং এই নভেল করোনা ভাইরাস হলো সপ্তম। এছাড়া এর আগে যে সকল করোনা ভাইরাস ছিল তা এত বড় মহামারী আকার ধারণ করে নাই।
করোনা ভাইরাস এর উৎপত্তি স্থল:
আমরা সকলে জানি যে কোন ভাইরাস কোন না কোন প্রাণীর মাধ্যমেই মানুষের দেহে প্রবেশ করে। এরকমই করোনা ভাইরাসও কোন প্রাণীর থেকেই মানুষের শরীরে এসেছে।ধারনা করা হয়েছে মানুষের দেহে এই ভাইরাস সংক্রমণ প্রথম ছড়িয়েছে চীনের উহান শহর থেকে। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন বন্য প্রাণীর জীব জন্তু এবং পোকা মাকড়ের বিশাল বাজার। যেগুলো ওই এলাকার মানুষের প্রধান খাদ্য। এবং ধারণা করা হয় কিংশুক নামক এক প্রকার বাদুরের মাধ্যমে এই করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে।
করোনা ভাইরাসের লক্ষণ:
করোনা ভাইরাস সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই। রোগীর মধ্যে জ্বর, অবসাদ, শুষ্ক কাশি , শ্বাসকষ্ট সহ গলা ব্যথা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের এসকল উপসর্গ থাকলেও সাথে জ্বর থাকে না। এছাড়াও এর সাথে থাকে শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা। করোনা ভাইরাস মূলত মানুষের ফুসফুস আক্রান্ত করে। শ্বাসকষ্ট রোগীদের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এটি প্রথম দিকে সাধারণ জ্বর সর্দির মাধ্যমে শুরু হতে পারে এবং ক্রমান্বয়ে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। এবং পরবর্তীতে ফুসফুস এবং কিডনিকে আক্রান্ত করে এগুলো বিকল করে দেয়। আসলে দেখা যায় প্রবল শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় মতো জটিল সমস্যার এছাড়াও করোনা ভাইরাসের কারণে পক্ষপাতও হতে পারে। তাই এ সকল লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ট্রিটমেন্ট করতে হবে।
যেসকল রোগীদের ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে: বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়েছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম। কারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু অনিবার্য নয়। তবে এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার কারণ হচ্ছে এই ভাইরাসটি খুবই ধীরগতিতে আক্রান্ত করে তোলে মানুষকে। যার ফলে প্রাথমিক অবস্থায় কেউ বুঝতে পারে না সে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে কিনা। 5-7 দিন যাওয়ার পরে এর সকল লক্ষণ পরিষ্কার হতে শুরু করে। রোগী বুঝতে পারে সে কারোনায় আক্রান্ত হয়েছে।লক্ষন প্রকাশে দীর্ঘ সময় নেওয়ার ফলে এই সময়ের মধ্যে অন্যরাও আক্রান্ত হয়। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সুস্থ এবং সবল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস তেমন মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এবং অধিকাংশ সুস্থ-সবল ব্যাক্তি করোনাই আক্রান্ত হওয়ার পরে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। কিন্তু যে সকল ব্যক্তি শারীরিক ভাবে খুবই দুর্বল এবং অসুস্থ তাদের ক্ষেত্রে করোনা মারাত্মক আকার ধারণ করে। অসুস্থ ব্যক্তিদের ফুসফুস দ্রুত সংক্রমিত করে তোলে এই ভাইরাসটি।এর থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়ার মাধ্যমে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে অসুস্থ ব্যক্তিদের।এক সমীক্ষায় দেখে গিয়েছে যারা মারা গিয়েছে তারা সকলেই বৃদ্ধ ও অসুস্থ ছিলেন। যে সকল ব্যক্তিদের শ্বাসকষ্টের এবং অন্যান্য শারীরিক জটিলতা রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
করোনাভাইরাস শিশুদের জন্য কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ : বিশ্বে প্রচুর পরিমাণে ব্যক্তিগণ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এর সাথেই রয়েছে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা জড়িয়ে আছে। তবে করোনাভাইরাস শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা অনেক ঘটেছে এখন পর্যন্ত কোনো শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। বিশেষজ্ঞরা এর কারণ হিসেবে মনে করেন বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। আর এ কারণেই কোনো শিশু মৃত্যুর ঘটনায় এখনও ঘটেনি। থেকে বোঝা যায় করোনাভাইরাস এর থেকে শিশুরা অনেকটা নিরাপদে রয়েছে। তবে এর পরেও শিশুদের বিশেষ খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি। কারণ শিশুরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা দ্রুত অন্যদের মাঝেও ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। কারণ তারা এ বিষয়ে সচেতন নয়। তাই আমাদের বড়দের উচিত যাতে শিশুদের মাঝে ভাইরাস ছড়াতে না পারে তার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
যেভাবে নিরাপদ থাকা যায় করোনাভাইরাস থেকে: যেহেতু করোনা ভাইরাস এর এখন পর্যন্ত কোন প্রতিশোধক আবিষ্কৃত হয়নি। তাই একমাত্র সচেতনতাই পারে বিস্তার রোধ করতে। এজন্য আমাদের সকলকে বিশেষ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে যেমন। বিনা প্রয়োজনে বাইরে যাওয়া চলবে না। খাওয়ার আগে পড়ে এবং বাইরে কোথাও গেলে বা মলমূত্র ত্যাগের পরে ভালো করে সাবান অথবা হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুতে হবে। কোন কাজে বাইরে যেতে হবে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এছাড়া বাড়িতেও মাস্ক পড়বেন। যেহেতু করোনা ভাইরাস এর আকার অন্যান্য ভাইরাস এর তুলনায় অনেক বড় তাই এটি প্রতিরোধে অন্যতম উপায় হতে পারে মাস্ক পড়া। এছাড়াও এখন বর্তমানে আমাদের দেশেও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে তাই এখনই আমাদের সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে এবং যেকোন ধরনের জনসমাবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে। এবং জনসমাবেশ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ জনসভার কারণে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।একে অপরের সাথে কোলাকুলি এবং বিভিন্ন কাজে কারো সংস্পর্শে আসা যাবে না।
ভীতি নয় বরং জন সচেতনতাই পারে আমাদের এই ভাইরাসের মহামারীর হাত থেকে রক্ষা করতে। তাই সকলের ভেতর এই করোনা ভাইরাস সম্পর্কে ভীতি নয় জন সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এবং ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। কোন ব্যক্তি এ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তার থেকে যাতে অন্যদের মাঝে ভাইরাস ছড়াতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। তাহলেই এর ভয়াবহতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারব সকলকে।