দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও তার প্রতিকার রচনা
সংকেত: সূচনা-দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিণাম -দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকার -শেষ কথা।
সূচনা : মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অর্থনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষ কাজ করে জীবিকার তাগিদে। উপার্জিত অর্থ সে তার দৈনন্দিন খরচে ও ভবিষ্যতের সয়ের জন্য রাখে। বর্তমান পৃথিবীতে স্বল্প আয়ের লােকের সংখ্যা বেশি। ফলে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয় অনেক হিসাব নিকাশ করে। আর আমাদের দেশে বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। অর্থনৈতিক প্রাচুর্য না থাকায় অনেক কষ্টে চলে তাদের সংসার জগৎ। তার উপর যদি নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায় তবে তাদের ভােগান্তি আর শেষ থাকে না। যাপিত জীবন হয় সঙ্কটাবর্তের ঘুরপাকে সীমাবদ্ধ।
Read more: দুর্নীতি ও তার প্রতিকার রচনা
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি কারণ : পণ্য উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে যখন কোনাে প্রকার সামঞ্জস্য না থাকে তখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা দেয় ।ফলে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সাথে দ্রব্যমূল্য সমন্বয় সাধন করতে পারে না; সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক সংকটের। জীবন ধারণের জন্য মানুষের কিছু মৌলিক চাহিদা আছে, যা ব্যতীত সে জীবনধারণ করতে পারে না। সারা বিশ্বের মতাে আমাদের দেশেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে; সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে চাহিদার পরিমাণও। সুতরাং ক্রমবর্ধমান জনগােষ্ঠীর চাহিদা মেটানাে দুরুহ বলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘটনাও স্বাভাবিক বলে বিবেচনার যােগ্য। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কতিপয় কারণ রয়েছে-
১। জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় উৎপাদন কম হচ্ছে; ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২। আমাদের দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঘন ঘন হরতাল ও ধর্মঘটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়। কাজেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
৩। ফারাক্কা বাঁধের বিপরীত প্রক্রিয়ায়, লবণাক্ততায়, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
৪। দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির আরেকটি কারণ সরকার কর্তৃক কর আরােপ। তৃতীয় বিশ্বের অধিক আর্থিক সংকট কাটানাের জন্য আমদানিকৃত ও দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের উপর বিপুল পরিমাণ কর আরােপ করা হয়। ফলে দ্রব্যের মূল্যের ওপর তার প্রভাব পড়ে।
৫। বেশি লাভ ও অবৈধ লােভের জন্য মজুতদারি ও চোরাকারবারিরা দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করে।তারা দেশের পণ্য বিদেশে পাচার করে দেয়। তাদের হাতে অবৈধ উপায়ে কালাে টাকার পাহাড় জমে। ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
৬। বিদেশী সাহায্য দেশে মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করে। আর মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যের দাম বেড়ে যায়।
৭। আমাদের দেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে কোনাে বছর উৎপাদন কম হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় ।
৮। প্রশাসনিক দূনীতি যেমন অবৈধভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানাে, কালােবাজারি, মজুতদারি, চোরাকারবারি, দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়।
৯। অসস্থ প্রতিযােগিতার মাধ্যমে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি হয়। একজন বিক্রেতা পাইকারি বাজারে যদি অন্য ক্রেতার সাথে পাল্লা দিয়ে বেশি দামে পণ্য ক্রয় করে তবে বিক্রয়মূল্য তাে বাড়বেই।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিণাম : ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিণাম খুবই ক্ষতিকর । উপযুক্ত যে সব কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে তার প্রভাব সবটাই জনগণের উপর পতিত হয়। একজন ক্রেতাকে বাঁচার তাগিদে কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হয়।বিত্তশালী বা কালাে টাকার অধিকারীরা যে কোনাে মূল্যে দ্রব্য ক্রয় করতে পারে । তবে দেশের অধিকাংশ মানুষ স্বল্প আয়ের মধ্যে জীবনযাপন করে। কাজেই তাদের দ্বারা অতিরিক্ত মূল্যে প্রয়ােজনীয় জিনিস ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব। তাই বাজারে যদি জিনিসপত্রের দাম বাড়ে তবে তাদের ব্যয় বরাদ্দ সংকুচিত হয়ে যায়। দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সুতরাং তারা অতিরিক্ত দামে দ্রব্য কিনতে দারুণ অসুবিধার সম্মুখীন হয়। বাজেট ঘাটতির কারণে অনেক পরিবার শিশুপণ্য ও ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যয়ভার সঙ্কুচিত করে ফেলতে বাধ্য হয়। ফলে শিশুর পুষ্টিহীনতা ও ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষা জীবন ব্যাহত হয়। আবার অনেকে আর্থিক সংকট কাটানাের জন্য অবৈধ উপার্জনের দিকে মনােযােগী হয়। ফলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় অবধারিত।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিকার : দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রােধ করতে হলে সর্বপ্রথম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে হবে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা অনেকটা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর নির্ভর করে। কাজেই দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একান্ত অপরিহার্য। অবৈধভাবে দ্রব্য পাচার রােধ ও মজুতদারি রােধ করতে পারলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে না। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থায় কৃষির উৎপাদন বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষি জমি থেকে সর্বোত্তম ফসল লাভের জন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, প্রচুর সার ও সেচ ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে। কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বাড়লে দাম এমনিতেই স্থিতিশীল থাকবে। বাজারের উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। মুনাফাখােরদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশের বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানা গুলাের আধুনিকায়ন ও উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে পণ্যের যােগান ঠিক রাখতে হবে। দেশে লাগামহীন দুর্নীতির অবসান ঘটাতে হবে।সবচেয়ে বড় কথা হল, দেশের সকল মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়ােগ করতে হবে।
শেষ কথা : দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ও কষ্টের সম্মুখীন হয় স্বল্প আয়ের মানুষরা। সুতরাং এদের স্বার্থ রক্ষার জন্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। বাজারের ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। তবে অতি দুঃখের সাথে জানাতে হয় যে, আমাদের দেশে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের উপর তথা বাজারের ওপর সরকারের কোনাে নিয়ন্ত্রণ নেই। অসাধু ব্যবসায়ী যাতে তার ইচ্ছামতাে দুব্যের মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে সে জন্য দেশের জনগণকে সচেষ্ট থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, মনাফাখখার সমাজে উন্নয়নের পথে প্রধান অজ্ঞায়। তাই অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।