আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রচনা

ভূমিকা:
“আবার ফুটেছে দেখ কৃষ্ণচূড়া
থরে থরে শহরের পথে।
কেবল নিবিড় হয়ে কখনওবা
একা হেঁটে যেতে মনে হয়, ফুল নয় ওরা,
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ
স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রঙ।”
—শামসুর রাহমান

বাইসনের সেই গুহা থেকে মানুষ যেদিন বেরিয়ে এলাে, দেখল নতুন পৃথিবী-আবিষ্কার করল নিজেকে আলাদাভাবে। সেদিন বুঝতে পারেনি তারাও এ পৃথিবীতে শিল্পের উন্মেষ ঘটাবে। আর জীবনের প্রয়ােজনেই তারা গুহাতে এঁকেছিল শিকারের অসংখ্য কৌশল। তারপর এ মানুষই বিপদসঙ্কুল জীবনযাত্রাকে আরাে সহজসাধ্য করার তাগিদ অনুভব করল। কল্পনা করল এক অনাবিষ্কৃত সারল্য। সেই কল্পনা বাস্তবে রূপ নিল।সৃষ্টির স্বপ্ন হলাে উন্মােচিত। আবিষ্কৃত হলাে লেখার হরফ। সেই হায়ারােগ্লিফিকের যুগ থেকে অক্ষর এখন মুক্তবিহঙ্গ। পরিশেষে সৃষ্টি হলাে ভাষা। অঞ্চলভেদে এর পার্থক্য ক্রমে বাড়তে লাগল। তারপর গড়িয়ে গেল হাজার হাজার বছর । বাদ পড়ল না বঙ্গোপসাগরবিধৌত এ অলটিও। জন্ম নিল আর্য-অনার্যসহ সংস্কৃত আর বাংলার ঐশ্বর্য, রূপ বৈচিত্র্যে মুগ্ধ হয়ে আরব, ইরান, তুরান, আফগান, তুর্কি, মােগলের সহমিলনে জন্ম নিল এক শিশু। শিশুটি আর কেউ নয়, বাঙ্গালা। এরই পরিবর্তিত রূপ বাংলা। Read more: রচনা ৭ মার্চের ভাষণ

একুশের স্বরূপ : একটি ভাষা থেকে উৎপত্তি হলাে বাঙালি জাতির। যে জাতির রয়েছে হাজার বছরের বীরত্বগাথা। যে জাতির অন্যতম সৃষ্টি মহান একুশ। একুশ—একটি চেতনা, একটি বৈশ্বিক প্রতীক, এক মহাবিস্ফোরণ । একুশ এখন সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রায় ৬৭০০ ভাষার সাথে পৃথিবীর সব ভাষাই আজ একুশের বন্ধনে আবদ্ধ। একুশ হলাে বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এবং বিভিন্ন জাতি ও ভাষাগােষ্ঠীর হিরন্ময় প্রতীক।

Read More  আবেদন পত্র বা দরখাস্ত লেখার নিয়ম

ভাষা আন্দোলন: ভাষার অধিকারের জন্য জনগণের এ অতলনীয় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ হঠাৎ এসে হাজির হয়নি। এর সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নরুপ :
১৯৪৭-এর জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম বক্তব্য রাখেন।

২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদের আইনবিধি সংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে ইংরেজি ভাষার সাথে উর্দু ভাষার নাম সংযুক্তির চেষ্টা করা হলে বাঙালি সংসদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার সাথে বাংলা’ সংযুক্তির দাবি জানালে পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।

১১-১৫ মার্চ পর্যন্ত (১৯৪৮) ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তােলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। কিন্ত ২১শে মার্চ ১৯৪৮ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বলেন, But let me make it very clear to you that the State
Language of Pakistan is going to be Urdu and no other language. Any one who tries to mislead you is really the enemy of Pakistan.

২৬শে জানুয়ারি ১৯৫২ সালে গভর্নর জেনারেলের মদদপুষ্ট হয়ে মুসলিম লীগের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় বলেন, “উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” শুরু হয় চুড়ান্ত ভাষা বিদ্রোহ।

Read More  Paragraph The Tree Lover

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালায়। নিহত হয় সালাম,

বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরাে অনেকে। অবশেষে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য বাঙালিদের আত্মাহুতির ফলেই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাই আজ আমরা পেয়েছি সার্বভৌম বাংলাদেশ।

বাংলা ভাষা ক্রমেই বিস্তার লাভ করছে। এক হিসাবে জানা যায়, পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। ভারতবর্ষের প্রায় ১৭শ ভাষাভাষী জনগােষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষাভাষীদের অবস্থান আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। কেননা আমাদের আছে নিজস্ব রাষ্ট্র।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : বাংলা ভাষা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকত। একশে ফেবয়ারি আজ সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার মানুষদের নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সবসম্মফ্রিমে অনুমােদিত হয় । ইউনেস্কোর ঘােষণায় বলা হয়, 21st February is proclaimed International Mother Language Day throughout the world to commemorate the martyrs who sacrificed their lives on this day in 1952.

সবচেয়ে প্রণিধানযােগ্য বিষয় হলাে-স্বাক্ষরিত আঠাশটি দেশের মধ্যে পাকিস্তানও আছে। যে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরােধিতায় ঢাকার রাজপথ বাংলার সংশপ্তকদের রক্তে রঞ্জিত করেছিল। যা সত্যিকার অর্থে বাঙালির নৈতিক বিজয়।যে দুই জন বাঙালি ভিনদেশি মাটিতে অবস্থান করে মাতৃভাষার এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন তাদের নাম রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে ৫২-র ভাষা আন্দোলনে নিহত সংশপ্তকদের নামের সাথে এদের আশ্চর্যরকম মিল। আর এভাবেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বহু বিবর্তনের মাধ্যমে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সত্যিই অমরত্ব লাভ করেছে। আমরা গর্ব করি ৫২ সালের শহিদদের নিয়ে। এর পাশাপাশি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে যাদের অবদান রয়েছে তাদের।

Read More  পহেলা বৈশাখ রচনা

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, একুশ আজ বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এ দুর্লভ অর্জন যেমন আনন্দের, তেমনই এ দিবসের দর্শন তথা মর্মবাণী বা চেতনা বাস্তবায়নে আমাদের এখনও অনেক কর্তব্য রয়েছে। এতে শুধু আত্মতৃপ্তির অবকাশ নেই। আমাদেরও উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাষা, সংস্কৃতিকে রক্ষা ও সমৃদ্ধ করার জন্য। সর্বস্তরে বাংলা শুদ্ধভাবে এখনও প্রচলন হয়নি। এটিকে কেবল জাতীয় পর্যায়েই নয়।আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও নজর দেওয়া আশু প্রয়ােজন। তাহলেই অমর একুশে ফেব্রুয়ারির সেই আত্মত্যাগ সার্থক হবে।

About the Author:

Habibur Rahman is an expert writer about Bangla poems, romantic stories, captions, status and quotes. He is writing about all romantic and motivational quotes, poems, captions, and status messages from the past 12 years. He has completed honors and master's degrees in literature from Dhaka University.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *