প্রাচীন যুগে রােমান সাম্রাজ্যের পতন বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সাম্রাজ্য ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রতিষ্ঠা, প্রসার, অবক্ষয় ও পতন হয়। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন এর মতে, সম্রাজ্য মানুষের মতাে জন্ম ও মৃত্যুর অধীন। রােমান সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি । রােমান সাম্রাজ্যের পতনের বহুবিদ কারণ ছিল, যেমন- সম্রাটদের অযােগ্যতা, সেনাবাহিনীর দুর্বলতা, জার্মান আক্রমণ, অর্থনৈতিক সংকট, রােমান সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত করেছিল । ঐতিহাসিক গিবন রােমান সাম্রাজ্যের পতনের জন্য খ্রিস্টধর্মের প্রসারকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নিম্নে রােমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণসমূহ উল্লেখ করা হলাে :
রাজনৈতিক সংকট : রােমান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ছিল সিংহাসন নিয়ে বিভিন্ন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিরােধ । মার্কাস অরেলিয়াসের পুত্র কমােডাস। (Commodus) ১৮০ হতে ১৯২ খিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হন। তারপর অভিজ্ঞ আইনবিদ, সৈনিক ও শাসন কার্যে পটু সেপটেমিয়াস সেভেয়াস রাজত্ব করেন। এরপর রাজত্ব করেন ক্যারাকেলা। এর পর এক অরাজতার সূত্রপাত হয়। সামরিক বাহিনীর প্রতাপ বৃদ্ধি পায়। ২৩৫ খ্রিস্টাব্দ হতে ২৮৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এদের প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে। এদের খেয়াল খুশি মতাে শাসকের পর শাসক আসতে থাকে। এভাবে দুই ডজন লােক ক্ষমতায় আসীন হয় আবার ক্ষমতা হারায়।। ইতােমধ্যে অন্য এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। জার্মানরা গল, ব্রিটেন, স্পেন ইত্যাদি আক্রমণ করতে থাকে। প্রাচ্যে সাসানীয় বংশের অধীনে পারস্যের উত্থান ঘটে। ২৬০ খ্রিস্টাব্দে পারস্য বাহিনী রােমান সম্রাট ভ্যালেরিয়ান ও তার কিছু সেনাবাহিনীকে বন্দী করে রােমকে অপমানিত করেন।
এর পর দুই জন সৈনিক সম্রাট ডিওক্লেশিয়ান ও কনস্টান্টাইন শাসনদণ্ড পরিচালনা করেন। প্রথম সম্রাট রাজত্ব করেন কুড়ি বা একুশ বছর এবং দ্বিতীয় জন। রাজত্ব করেন ত্রিশ বা একত্রিশ বছর।
ডিওক্রেশিয়ান প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সামরিক শক্তি হ্রাস করেন। যাতে তারা বিদ্রোহ করার সুযােগ না পায়। দ্বিতীয়ত, প্রদেশের আয়তন তিনি হ্রাস করেন। তৃতীয়ত, তিনি প্রদেশের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। ফলে প্রদেশের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় একশ। কনস্টান্টাইন ৩০০ খ্রিস্টাব্দে রােমের পূর্বাংশের রাজধানী স্থাপন করেন গ্রিক বাইযানটিয়ামে। যার নামকরণ করা হয় কনস্টান্টিনােপল সম্রাটের নামে। পাশ্চাত্যে রােমের রাজধানী রােম হতে মিলান নগরীতে স্থানান্তরিত হয়। প্রাচ্য ও প্রতীচ্য দুই ভাগে সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায় চিরতরে ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রােমের পতন ঘটে। ইতােমধ্যে খ্রিস্টানধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে এবং জার্মানদেরও উত্থান হয়।
পতনের পূর্বমুহূর্তে রাজনৈতিক অবস্থাঃ
ডাইক্লেশিয়ান এবং কনস্টান্টাইনের সংস্কার সত্ত্বেও সিংহাসন নিয়ে হত্যা ও ষড়যন্ত্র লেগে থাকে। গৃহ বিবাদের পর কনস্টান্টাইনের পরিবারের প্রায় সকল সদস্যই নিহত হয়েছিল। কেবল মাত্র জুলিয়ান (Julian) রক্ষা পেয়েছিল। জুলিয়ানই ছিলেন কনস্টান্টাইন পরিবারের শেষ ব্যক্তি যিনি সৈনিকগণ কর্তৃক ৩৬০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট বিঘােষিত হয়েছিলেন। অবশ্য এক জুলিয়ান পৌত্তলিকতা আবার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। কিন্তু সম্রাট জেভিয়ান (Jovian) আবার খ্রিস্টধর্মকে রাজধর্মে পরিণত করেন। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার জন্য পরবর্তী সম্রাটগণ সীমান্ত রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। রােমের পতনের কারণ নিয়ে আলােচনা করা হলাে :
অর্থনৈতিক কারণ : রােমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল দাস নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার ভাঙন। সাম্রাজ্যের শেষ পর্যায়ে রােমে করদাতা অপেক্ষা। কর আদায়কারীর সংখ্যা ছিল বেশি। এ করের বােঝা বহন করতাে বণিকরা। রােমের কৃষি অর্থনীতি নির্ভর ছিল ভূমিদাসদের শ্রমের উপর নির্ভরশীল। অভিজাতরা ভূমি দাসদের বাধ্যতামূলক শ্রম দানে বাধ্য করতাে। ভূমিদাসদের শ্রম অনুৎপাদনশীল খাতে নিঃশেষ হতাে। দাসদের জীবন অপেক্ষা তাদের শ্রমের মূল্য ছিল বেশি। অতিরিক্ত শ্রমে অনেক ভূমিদাস মৃত্যুবরণ করে। এহেন অবস্থায় সমাজে শ্রম সংকট ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। রােমের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মুদ্রায় অতিরিক্ত খাত মিশানাে হয়। ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্য ভেঙে পড়ে। আমদানি নীতির ফলে রােমের সােনা, রুপা বিদেশে চলে যায়। এ অবস্থায় শাসকদের পক্ষে সেনাবাহিনী গঠন ও যুদ্ধ ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন। হয়ে পড়ে।
জাতীয় চেতনার সংকট : রােমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে রােমানদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ও চেতনা শক্তিশালী ছিল কিন্তু কালক্রমে রােমান সাম্রাজ্য এশিয়া, ইউরােপ ও আফ্রিকায় বিস্তার হলে বিভিন্ন জাতি গােষ্ঠী মানুষ রােমান নাগরিকত্ব লাভ করে । রােমানরা ব্যবসায়, কৃষি এবং বাণিজ্যিক কারণে বিদেশে পনিবেশ গড়ে তােলে। এতে অনেক রােমান বিদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। রােমান সেনাবাহিনীতে বহু। জার্মান জাতির অনুপ্রবেশ ঘটে। ফলে রােমানদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়। বহু জার্মান এবং এশিয়া রােমান সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে চাকরি গ্রহণ করে। ফলে রােমান ভাষা। ল্যাটিন এবং রােমান আইন ছাড়া রােমানদের প্রাথমিক বলবীর্যের ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়।
বর্বর আক্রমণ : রােমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল রােমের বিভিন্ন সীমান্তে বর্বর আক্রমণ। পূর্ব সীমান্তে পারস্য সাম্রাজ্য, শাসনীয় বংশের অধীনে শক্তিশালী হয়ে পশ্চিমে রােম সাম্রাজ্যের অঞ্চল দখল করার জন্য তৎপর হয়। রােমান সম্রাট জুলিয়ানের উত্তরাধিকারী জুবিয়ান পারস্য সম্রাটকে পাঁচটি প্রদেশ ছেড়ে দেন। উত্তর এশিয়ার রামরা শক্তিশালী হয়ে উঠে। পশ্চিম সীমান্তে বিভিন্ন জার্মান জাতিগােষ্ঠী আক্রমণ শুরু করে। জুলিয়াস সিজার জার্মান রাজা এরিওভিসটাসের আক্রমণ প্রতিহত করলেও তখন থেকেই জার্মানরা রােমান সাম্রাজ্য আক্রমণে তৎপর ছিল। পরবর্তীকালে। দুর্বল সম্রাটদের সময় জার্মানরা রােমের সীমান্ত প্রদেশে অনুপ্রবেশ শুরু করে। তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগ ও শেষ ভাগে জার্মান আক্রমণ প্রকট হয়। আলেমানী জাতি (The Alemanni) পশ্চিম সীমান্ত হতে উত্তর ইতালি মিলান আক্রমণ করে। জার্মান জাতির গথ জনগােষ্ঠী দানিউব নদী আক্রমণ করে পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করে সম্রাট ডেসিয়াসকে হত্যা করে। গথগণ দানিউব নদী অতিক্রম করে রােমান সাম্রাজ্যের সীমান্ত প্রদেশে বসতি স্থাপন করে এ সময় এশিয়ার হুনগণ জার্মানদের আক্রমণ করলে তারা রােমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ঢুকে পরে। ইউরেশিয়ায় বসতি স্থাপনকারী গথগণের উপর যখন হুনরা আক্রমণ কড়ে তখন ওষ্ঠগথ বা পূর্বাঞ্চলীয় গথগণ তাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু ভিজিগথ বা পশ্চিমাঞ্চলীয় গথগণ রােমানদের আশ্রয় লাভ করে। কিন্তু রােমান কর্মচারীরা তাদের উপর অত্যাচার করলে তারা বিদ্রোহ করে সম্রাট ভেলেনকে হত্যা করে।
রােমান সম্রাট থিউডােসিয়াস (৩৭৯-৩৯৫) দানিউব নদীর দক্ষিণ অঞ্চলে। গথগণকে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়ে এ অঞ্চলে প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় করে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর রােমান সাম্রাজ্য তার দুই পুত্রের মধ্যে বিভক্ত হয়। পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্য পান হনরিয়াস এবং পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য লাভ করেন আর্কাডিয়াস। পূর্ব রােমান সাম্রাজ্য পরবর্তী এক হাজার বছর অটুট ছিল। কিন্তু পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্য বিভিন্ন জার্মান সেনাপতি এলারিক, আটিলা, জেজারিক এবং ওডােসার আক্রমণে ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে পতনের সম্মুখীন হয়। হনরিয়াস এর রাজত্বকালে পশ্চিমাঞ্চলীয় গথগণ তাদের নেতা এলারিকের নেতৃত্বে গ্রিসের মধ্য দিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করে। হনরিয়াস ভ্যান্ডাল সেনাপতি স্টিলিকো এলারিকের এ আক্রমণ ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রতিহত করেন। ৪১০ খ্রিস্টাব্দে এলারিক আল্পস পর্বত অতিক্রম করে রােমের দারপ্রান্তে উপস্থিত হয়ে রােমানদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে। এলারিক সম্রাট হনরিয়াসের নিকট তার সেনাবাহিনীর জন্য ভূখণ্ড দাবি করলে হনরিয়াস তা প্রত্যাখান করে। এলারিক ক্ষুব্ধ হ=ে রােম আক্রমণ করে যাজক ও গির্জার সম্পদ ছাড়া রােমের নাগরিকদের সব কিছু লুণ্ঠ করেন। এলারিকের মৃত্যুর পর জার্মান জাতিসমূহ সাম্রাজ্যের পশ্চিম প্রদেশগুলােতে বসতি স্থাপন করে। ভিজিগথরা আল্পস অতিক্রম করে গল প্রদেশের (ফ্রান্স) দক্ষিC এবং স্পেনে বসতি স্থাপন করে। বর্বর জার্মান জাতির মধ্যে ভ্যান্ডালরা পিরেনীজ পর্ব অতিক্রম করে স্পেনে আক্রমণ চালায়। তখন থেকেই একে আন্দোলেশীয় বা স্টে বলা হতে থাকে। অন্যদিকে ফ্রান্স, ফ্রাংক জাতি গােষ্ঠী এলারিকের রােম আক্রমশে অনেক পূর্ব থেকেই রাইন নদীর পশ্চিমে বসতি স্থাপন করতে থাকে। রােমের পত, পর এরা ফরাসি জাতি হিসেবে পরিচিত হয়। স্টিলিকু পতনে এলারিকের আত্র= প্রতিহত করতে ব্রিটেন থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে উত্তর সাগরের তীর থেকে এ্যা এবং সেকশন জাতিসমূহ ব্রিটেনে এসে ইংরেজ জাতির সূত্রপাত করে।