শীতের সকাল রচনা

শীতের সকাল রচনা / শীতকাল

ভূমিকা :
এসেছে শীত গাহিতে গীত বসন্তেরি জয়,
যুগের পর যুগান্তরে মরণ করে নয়। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাংলার শীত কাব্যে উপেক্ষিত। মেঘ-মেদুর বিরহী, চিত্তহারিণী বর্ষা, শরতের স্বর্ণমাধুর্য, বসন্তের আনন্দ হিল্লোলে মুখর কবিকুল। কিন্তু এত অবহেলা রিক্ত, রুক্ষ, কঠোর, শ্রীহীন শীত বলে। অথচ এ শীতেরও বড়াই করার মতাে অনেক কিছু আছে। আসলে সব সৃষ্টিই আপন সৌন্দর্যে দীপ্ত। শীতেও আছে আপন সম্পদ। সরষে ক্ষেতের শীত মাধুরী, অতসী, গাঁদা, দোপাটি, ডালিয়ার রূপের ডালি। আছে তৃণ শীর্ষের একটি শিশির বিন্দু। Read more: পহেলা বৈশাখ রচনা

শীতের স্বরুপ : সত্যিই শীতের সকাল বড়ই আমেজি। কী গ্রামে, কী শহরে শীতের রাত শেষ হয়ে ভাের হলেও ভােরের মেজাজ তাতে আসে মনে হয়-থাকি না আরেকটু সময় লেপমুড়ি দিয়ে। উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছা করে না। ওদিকে অপূর্ব শান্ত প্রকৃতি ভােরের আবছা আলাে আঁধারিতে কেমন যেন রহস্যঘন রূপ ধারণ করে উদার প্রকৃতির বুকে আশ্রয় নিতে হাতছানি দেয়।এই হলাে শীতের সকালের এক ঝলক চিত্র । ষড় ঋতুর দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে একের পর এক ঋতু আসে আর যায়। কবির ভাষায়,

“ঋতুর দল নাচিয়ে চলে
ভরিয়া ডালি ফুল ও ফলে
নৃত্যলােকে চরণতলে মুক্তি পায় ধরা
ছন্দে মেতে যৌবনেতে রাঙিয়া উঠে জরা।”

নানা ঋতুর আগমনে এ বাংলার প্রকৃতি তখন নানা রপ ধারণ করে। এখানে সকাল ও বিকাল, সন্ধ্যা ও রাত্রি বিভিন্ন ঋতুতে স্বতন্ত্র বিশিষ্টতা নিয়ে হাজির হয়। বিচিত্র ও মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয় এ সব ঋত পরিক্রমা। হেমন্তের পর শীত এলে প্রকৃতি রিক্ততার সন্ন্যাসী রূপ ধারণ করে। বন-বনানীর বুকে গাছের ঝরা পাতায় বেজে ওঠে বিষাদময়তার সুর । আর তখনই শীত তার ফুল, ফল ও ফসলের ঘ্রাণ নিয়ে,তার সৌন্দর্য ও উৎসব পরিপূর্ণ জীবনের পশরা নিয়ে আগমন করে।

Read More  Paragraph The Tree Lover

শীতের সকাল : শীতের সকাল সত্যিই অসাধারণ। কী শহুরে জীবন, কী গ্রামীণ জীবন সব ক্ষেত্রেই শীতের সকাল প্রভাব ফেলে। কার্তিক থেকেই দিন খুব ছােট এবং রাত বাড়তে বাড়তে পৌষের দিন সবচেয়ে ছােট ও রাত বড় হয়। আর প্রকৃতিতে যেমন আসে পারবতন ঠিক তেমনি আসে জীবনযাত্রাতেও।
শীতের শিশিরভেজা ভােরের প্রকৃতিকে মনে হয় নিদারুণ বিমর্ষ। কুয়াশা তার সাদা আঁচলে প্রকৃতিকে অপূর্ব মায়ায় জড়িয়ে রাখে। কনকনে ঠাণ্ডা হাড় কাঁপানাে বাতাস পুরাে প্রকৃতিকে নিষ্ঠুর শীতের চাবুক মারতে মারতে অবসন্ন করে তােলে। কবির ভাষায়,
“হিম হিম শীত শীত
শীত বুড়ি এলােরে,
কন কনে ঠাণ্ডায়
দম বুঝি গেলােরে।”

গ্রাম বাংলার চিত্র :

সরষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হাওয়ার সুখে,
মটর বােনের ঘােমটা খুলে চুম দিয়ে যায় মুখে।
ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশি পউষ পাগল বুড়ি,

এ যেন গ্রামবাংলার শীতকালীন চিরচেনা রূপ। প্রথমেই আলােকময় উজ্জ্বল আকাশ শীতের সকালে অসম্ভব। বাংলার গ্রামে গ্রামে শীতের
সকাল সত্যিই মনােরম। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে শীতের সকাল। সকালবেলার সূর্যটা যখন পূর্ব আকাশে উকি দেয় তখনও নিদ্রা ছাড়ে না মানুষ। কেউ লেপের নিচে, কম্বলের নিচে গুটিয়ে রাখে নিজের শরীরটাকে, কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। একসময় কুয়াশার আচ্ছাদন পালিয়ে যায় উর্ধ্বলােকে। কিন্তু সেখানেও ঠাই নেই তার। উজ্জ্বল রােদের শাসনে শীতের সকাল নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে থাকে কোনাে গােপন পুরীতে। কাকের কা-কা ধ্বনি আর মােরগের কোঁকর কে ডাকে ঘুম ভাঙতেই সবাই গায়ে কাপড় জড়িয়ে আগুনের পাশে উবু হয়ে আগুন পােহাতে বসে। অন্যদিকে রাখালেরা গরুর পাল নিয়ে মাঠে যায়। চাষিবউ ধান সেদ্ধ আর চাল গুঁড়াে করতে মেতে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের পিঠার সমাহার ঘটে এ সময়। ভাপা পিঠা আর খেজুর রস প্রতিদিনকার ব্যাপার। পুকুরপাড়ে রােদে পিঠ ঠেকিয়ে ছােট ছােট
ছেলেমেয়েরা সুর করে বই পড়ে। মাঝে মাঝে শিরশিরে ঠাণ্ডা কনকনে উত্তুরে বাতাস আমলকি বনে কাঁপন লাগায়। প্রকৃতি ও মানুষ সেই
নাচনে শােনে ঝরাপাতার গান।

Read More  Nakshi Kantha Paragraph

শহরের চিত্র : শহরে শীতের সকাল আসে একটু দেরিতে। সেখানে দেয়ালগাত্রের মধ্যে উদার আকাশের দেখা মেলে না। ঘুম ভাঙানাের
জন্য কোন মােরগের কোঁকর কে ডাকও শােনা যায় না। গােয়ালা দুধ আনে, দুর্ভাগাকে বাজারের থলি হাতে যেতে হয় বাজারের পথে ।অফিস-আদালত শােনে না শীতের আর্জি। অঢেল সুলভ খাদ্যদ্রব্য, গ্রামাঞ্চলে উৎপাদিত ফসলের আনাগােনা শীতের মিঠে সকালকে রােমাঞ্ছিত করে। অফিসে বা ব্যবসাস্থলে যাবার তাগিদ অনুভূত হয় শীতের এ সাত-সকালেই।

উপসংহার : শীতের সকাল সভ্যতার যাতাকলে পিষ্ট হয়ে ক্রমেই তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশ শীতের সকালকেও যান্ত্রিক করে ফেলছে । মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। অথচ একসময়ে গাঁদা, সূর্যমুখী, রজনীগন্ধা, ডালিয়া প্রভৃতি ফুল উপহার দিয়ে শীতের সকাল নিজকে ধন্য মনে করত। ঋতুর পালাবদলে শীতের সকাল অন্যান্য ঋতুর সকাল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কেননা এ সময়ে আমরা ভুলে যাই।নিশীথ রাতের হিমঝরা কহেলি স্মৃতি । পরম সুখ চরম জীবনের হাতছানি দিয়ে ডাকে। আমরা ঘনিষ্ঠ হই। মিলিত হই মহাজীবনের পরিশুদ্ধ প্রান্তরে। আর শীতের সকালকে বরণ করি এই বলে,

“পৌষ এলাে গাে!
পৌষ এলাে অশ্রু পালার হিমঝরা
ঐ যে এলাে গাে-
কুজুঝটিকার ঘােমটা পরা দিগন্তে দাঁড়ায়ে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *