আজ আমরা জানবো মূল্যবোধ কি এবং মানবজীবনে নৈতিক মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা । মানুষ প্রাণিজগতের সদস্য হলেও পশুর সাথে তার পার্থক্য হলো তার কতিপয় মানবিক গুণাবলী। এসব গুণাবলীর কারণে মানুষ ভালো-মন্দ,ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বিচার করার ক্ষমতা লাভ করে। মানুষের সকল কাজের মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে এই মানবিক ও নৈতিক গুণাবলী সমূহ। তাই মানবসমাজ এই নৈতিকতার আশ্রয়ে গড়ে ওঠে। এমনই একটি গুণাবলী হলো তার নৈতিক মূল্যবোধ। মানবিক চরিত্রকে সুষমামণ্ডিত করে গড়ে তোলার জন্য এই গুণাবলী একান্ত জরুরি।
মূল্যবোধ কি ?
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে,
‘ যা আমাদের ভালো ও মন্দকে পৃথকীকরণে সাহায্য করে তাই মূল্যবোধ।’
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এটি গাইডের মতো সহায়তা করে। এর মাধ্যমে আমরা সমাজের ভালো কাজগুলো সমর্থন করার শক্তি পাই এবং অন্যান্য অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ কাজকে ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করতে পারি। কাজী মোতাহার হোসেনের মতে এটি হলো,
“নিকটবর্তী স্থূল সুখের চেয়ে দূরবর্তী সুখকে, আরামের চেয়ে সৌন্দর্যকে, লাভজনক যন্ত্রবিদ্যার চেয়ে আনন্দপ্রদ সুকুমারবিদ্যাকে শ্রেষ্ঠ জানা এবং তাদের জন্য প্রতীক্ষা ও ক্ষতি স্বীকার করতে শেখা।”
আর যুক্তিবিচার হলো ‘জীবনের সকল ব্যাপারকে বিচারবুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেবার প্রবণতা’। সুতরাং,মানব চরিত্রকে পরিষ্ফুটিত ও সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য এই গুণটি অতীব জরুরি।
পরিবেশভেদে মূল্যবোধের পার্থক্যঃ
সমাজ, পরিবেশ, সংস্কৃতি ইত্যাদি ভেদে মূল্যবোধের পার্থক্য হতে পারে। এর মূল কারণ হলো সেখানকার জনগণের জীবনযাত্রার মান ও মাধ্যম। একজন মানুষের মূল্যবোধ গড়ে ওঠে মূলত তার সামাজিকীকরণের উপর। সামাজিকীকরণের অনেকগুলো উপাদান রয়েছে। যথা: পরিবার, সমাজ, বন্ধ-বান্ধব,মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।পরিবার একজনের চরিত্র গঠনে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে। তার বন্ধু, প্রতিবেশী ইত্যাদি মাধ্যমে সে তার মূল্যবোধকে গড়ে তোলে। একজন মানুষ যখন একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে বসবাস করতে শুরু করে তখন সে সেই পরিবেশের নৈতিকতাকে অবচেতন মনে গ্রহণ করতে শুরু করে। যেমন: পশ্চিমা বিশ্বে মদ খাওয়া বৈধ হলেও আরব বিশ্বে তা সম্পূর্ণ অবৈধ ও নৈতিকতার অবমাননা। কারণ যারা পশ্চিমা বিশ্বে বসবাস করে তারা ছোটবেলা থেকেই তা সমাজে দেখে আসছে। আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যা কিছু শেখানো হয় তাই পরবর্তীতে তাদের চরিত্রকে গঠন করতে বিভিন্ন পরিবেশে মূল্যবোধ বিভিন্ন রকম হতে পারে। সমাজবিজ্ঞানীরা এটিকে মূলত চারটি ভাগে ভাগ করেছেন।যথা:
- ব্যক্তিগত
- সামাজিক
- রাজনৈতিক
- ধর্মীয়
ব্যক্তিগত মূল্যবোধ মানুষকে অনুভব করতে শেখায় যে কেন অন্যের ক্ষতি করা অনুচিত, কেন অপরকে সাহায্য করা উচিত ইত্যাদি। সামাজিক ক্ষেত্রে এটি মানুষের সমাজে বাস করা, আচার-আচরণ , পারস্পরিক সহযোগিতা ও সৌহার্দ্য, সহযোগিতা ইত্যাদি মনোভাব তুলে ধরতে সহযোগিতা করে। রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণটি হলো মূল্যবোধ। ধর্মীয় মূল্যবোধ সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক ধর্মই তার অনুসারীদের এই গুণাবলী অর্জনের জন্য আদেশ করে।
মূল্যবোধের গুরুত্ব:
কাজী মোতাহার হোসেন ফরাসিদের মধ্যে এই গুণটি লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে এই গুণটি ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরোপুরি মেনে চলার কারণে তারা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। তিনি আফসোস করেছিলেন বাঙালিদের মূল্যবোধহীনতার জন্য। যদি প্রতিটি বাঙালির জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে নৈতিকতার চর্চা করত তাহলে বাংলাদেশ আজকে বিশ্ব উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হতে পারতো। একজন প্রকৃত নেতা ও দেশপ্রেমিক কখনো জনগণের সম্পদ আত্মসাৎ করতে পারেন না। তিনি সবসময় সত্যের পথে তার কাজ পরিচালনা করবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আজকের পৃথিবীতে অধিকাংশ রাজনীতিবিদ মূল্যবোধহীন জীবনের প্রতি অগ্রসর হচ্ছেন। পৃথিবীর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূল একটি কারণ হলো এই মূল্যবোধহীনতা। আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্য নৈতিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম।
পরিশেষ:
একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের উচিত মূল্যবোধকে নিজের ভেতরে ধারণ করা কেননা এটি আমাদের আসল পরিচয় নির্ণায়ক। যেদিন আমরা সকলেই নৈতিক মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরে উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে পারব,কেবল সেদিনই সমাজ উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাবে। তাই আজ থেকেই আমরা সকলেই নিজ অবস্থানে থেকে নৈতিকতার চর্চা করতে শুরু করি।