মাকে নিয়ে কবিতা সেরা কবিদের বিখ্যাত ৫ টি কবিতা এখানে দেয়া হয়েছে । এর আগে আমরা মাকে নিয়ে উক্তি ও বাণী দিয়েছি । তাই অনেকেই মাকে নিয়ে কবিতা চেয়েছেন, তাদের জন্য আমাদের এই ছোট্ট কিছু কবিতার আয়োজন করা হয়েছে । মাকে নিয়ে এই কবিতা গুলো অনেক জনপ্রিয় তাই আপনাদের সাথেও শেয়ার করলাম ।
মাকে নিয়ে কবিতা :
বীরপুরুষ
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পাল্কিতে, মা চ’ড়ে
দরজা দুটো এক্তুকু ফাঁক ক’রে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার প’রে
টগ্বগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।।
সন্ধে হল, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধূ ধূ করে যেদিক পানে চাই,
কোনখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন মনে তাই
ভয় পেয়েছ ভাবছ, ‘এলেম কোথা।’
আমি বলছি ‘ভয় করো না মা গো,
ওই দেখা যাই মরা নদীর সোঁতা।’
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে-
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!’
এমন সময় ‘হাঁরে রে রে রে রে’
ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে?
তুমি ভয়ে পাল্কিতে এক কোণে
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরোথরো।
আমি যেন বলছি তোমায় ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন, মা, করো!’
তুমি বললে ‘যাস্ নে খোকা ওরে,’
আমি বলি ‘দেখো-না চুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়ায় হল মা যে
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।।
এত লোকের সঙ্গে লড়ায় ক’রে,
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়ায় গেছে থেমে,’
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল
কী দুর্দশাই হতো টা না হলে!’
মা
— কাজী নজরুল ইসলাম
যেখানেতে দেখি যাহা
মা এর মত আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত আদর সোহাগ সেতো
আর কোনোখানে কেহ পাইবে না ভাই।
হেরিলে মায়ের মুখ
দুরে যায় সব দুঃখ
মায়ের কোলেতে শুয়ে জোরায় পরান
মায়ের শিতল কোলে
সকল যথনা ভুলে
কতনা সোহাগে মাথা বুকটি ভরান।
যখন জন্ম নিনু
কতই না অসহায় ছিনু
কাঁদা ছারা নাহি জানিতাম কিছু
ওঠা বসা দূরে থাক
মুখে নাহি ছিল বাক,
চাহনি ফিরত শুধু মা এর পিছু পিছু।
পাঠশালা হাতে যবে
ঘরে ফিরে যাব সবে।
কতনা আদরে কোলে তুলে নেবে মাতা।
খাবার ধরিয়ে মুখে
শুনাবেন কত সুখে।
কত আজ লেখা হলো পড়া কত পাড়া।
পড়ালেখা ভালো হলে
দেখে সে কত ছলে
ঘরে ঘরে সে আমার কত নাম করতো,
বলে মোর সোনিমণি হিরার মানিকের খনি
এমনটি কারো শুনে বুক ভরে।
পল্লী জননী
— জসীম উদ্দীন
রাত থম থম স্তব্ধ, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি, তাও শোনা যায়, নাই কোথা সাড়া কার।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বিসয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা।
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে।
ভন্ ভন্ ভন্ জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান,
এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ?
ছোট কুঁড়ে ঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু।
ছেলে কয়, “মারে, কত রাত আছে? কখন সকাল হবে,
ভাল যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে?”
মা কয়“বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমা ত একটি বার, ”
ছেলে রেগে কয় “ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ?”
পান্ডুর গালে চুমো খায় মাতা, সারা গায়ে দেয় হাত,
পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ।
নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান,
ছেলেরে তাহার ভাল কোরে দাও, কাঁদে জননীর প্রাণ।
ভাল করে দাও আল্লা রছুল। ভাল কোরে দাও পীর।
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর।
বাঁশবনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,
বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারীর বন হেলি।
চলে বুনোপথে জোনাকী মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,
দুর ছাই। কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি।
যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,
বালাই, বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে।
ছেলে কয়, “মাগো! পায়ে পড়ি বলো ভাল যদি হই কাল,
করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে না ত তুমি গাল?
আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া
এখনি আমারে এত রোগ হোতে করিতে পারি ত খাড়া ?”
মা কেবল বসি রুগ্ন ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,
ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে।
“শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,
রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে।
খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে,
ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।”
ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,
বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,
কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দুর বনে।
সাঁঝ হোয়ে গেল আসেনাকো আই-ঢাই মার প্রাণ,
হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান।
এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,
ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি-সাঁঝে?
কত কথা আজ মনে পড়ে মার, গরীবের ঘর তার,
ছোট খাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার।
আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,
বলেছে আমরা মুসলমানের আড়ঙ দেখিতে নাই।
করিম যে গেল? রহিম চলিল? এমনি প্রশ্ন-মালা;
উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা।
আজও রোগে তার পথ্য জোটেনি, ওষুধ হয়নি আনা,
ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা।
ঘরের চালেতে ভুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,
মরণের দুত এল বুঝি হায়। হাঁকে মায়, দুর-দুর।
পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডা’ক ডাকিতেছে ঝুরি ঝুরি,
কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি।
ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে বুড়ো পাতা ঝরে বনে,
ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল গড়াইছে তার সনে।
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।
সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা।
পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেলা,
আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল।
কত ভালোবাসি
— কামিনী রায়
জড়ায়ে মায়ের গলা শিশু কহে আসি,-
“মা, তোমারে কত ভালোবাসি!”
“কত ভালবাস ধন?” জননী শুধায়।
“এ-ত।” বলি দুই হাত প্রসারি’ দেখায়।
“তুমি মা আমারে ভালবাস কতখানি?”
মা বলেন “মাপ তার আমি নাহি জানি।”
“তবু কতখানি, বল।”
“যতখানি ধরে
তোমার মায়ের বুকে।”
“নহে তার পরে?”
“তার বাড়া ভালবাসা পারি না বাসিতে।”
“আমি পারি।” বলে শিশু হাসিতে হাসিতে!
মাতৃভক্তি
— কালিদাস রায়
বায়েজীদ বোস্তামী
শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।
দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, ‘বাছাধন,
বড়ই পিয়াস, পানি দাও’ বলি মুদিলেন দুনয়ন।
দেখিল বালক ঘরের কোণের কলসিতে নেই পানি;
বহুদূর পথ ঝরণা হইতে কলসি ভরিয়া আনি
মায়ের তৃষ্ণা মিঠাইবে বলি গভীর অন্ধকারে
ছুটিয়া বাহির হইল একাকী কলসি লইয়া ঘাড়ে
জল ঢালি পিয়ালায়
সুপ্তা মাতার শয়ন-শিয়রে দাঁড়ায়ে রহিল ঠায়।
ভাঙিলে নিদ্রা হবে অপরাধ, কখন ভাঙিবে নিদ
সেই ভরসায় পানি হাতে খাড়া রহিল বায়োজীদ।
পূর্বগগন ফর্সা হইল, ডাকিয়া উঠিল পাখি,
জননী মেলিল আঁখি।
দেখিল, শিয়রে দাঁড়ায়ে রয়েছে দশ বছরের ছেলে,
পানি হাতে কেন- বুঝিল না মাতা প্রথম নয়ন মেলে।
সহসা পড়িল মনে
গভীর রাত্রে পিপাসার পানি চেয়েছিল বাছাধনে।
কহিল মা, ‘মরি মরি!
বাছারে আমার, পানি হাতে করে সারা রাত্রিটি ধরি
দাঁড়াইয়া আছে? ঘুমাওনি আজ?’- চোখে এল জল ভরি।
পুত্ররে কোলে নিয়ে মা চুমিল বার বার মুখখানি কহিল জননী, ‘নয়নের মনি, সাধারণ শিশু নও
খোদার দয়ায় বরকতে তুমি জগৎ পূজ্য হও।
পুত্র গর্বিত বুকে খোদা, স্মরি তব নাম,
তোমারে আমার জীবনের এই সম্বল সঁপিলাম।’
বিফল হয়নি মায়ের আশিস, হৃদয়ের প্রার্থনা,
জগৎ-বন্ধ্যা জ্ঞান-গুরুদের বায়েজীদ একজনা।
(ঈষৎ সংশোধিত)